1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

ইন্টার্ন চিকিৎসকেরা বেপরোয়া কেন?

সমীর কুমার দে ঢাকা
১১ ফেব্রুয়ারি ২০২৪

ইন্টার্ন চিকিৎসকদের বিরুদ্ধে মাঝেমধ্যেই রোগীর স্বজনদের মারধর বা লাঞ্ছিত করার অভিযোগ পাওয়া যায়৷ কেন তাদের এই আচরণ?

https://p.dw.com/p/4cFTJ
রাজশাহী মেডিকেল কলেজের সামনে এক ব্যক্তি
রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে রোগীর ছেলেকে মারধরে অভিযুক্ত ইন্টার্ন চিকিৎসকেরাছবি: Rubel Mahfuz

বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকেরা বলছেন, মেডিকেল কলেজ হাসপাতালগুলোতে বহির্বিভাগে ও জরুরি বিভাগে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেন ইন্টার্ন চিকিৎসকেরা৷ এসব হাসপাতালে রোগীর চাপ এত বেশি থাকে যে, তারা মাঝে মধ্যেই নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলেন৷ যদিও এটা কোনভাবেই কাম্য নয়৷ কোনো চিকিৎসক রোগীর স্বজনের গায়ে হাত তুলতে পারেন না৷ কেউ এমনটা করলে তার বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে৷

সর্বশেষ রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে একজন রোগীর ছেলেকে নির্দয়ভাবে পিটিয়েছেন ইন্টার্ন চিকিৎসকেরা৷ এই ঘটনায় হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছে৷ পাশাপাশি অভিযুক্ত দুই ইন্টার্ন চিকিৎসককে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে৷ শুধু রাজশাহী নয়, এর আগে বগুড়া, বরিশাল, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালেও একই ধরনের ঘটনা ঘটেছে৷ রাজশাহীতে দুই ইন্টার্ন চিকিৎসককে সাময়িক বরখাস্ত করা হলেও এর আগের কোন ঘটনায় ইন্টার্ন চিকিৎসকদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়ার কথা শোনা যায়নি৷

কী হয়েছিল রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে?

রাজশাহী শহরের বোসপাড়ার বাসিন্দা ও স্থানীয় মোবাইল যন্ত্রাংশের মিস্ত্রী সুমন পারভেজ রিপন তার মা পিয়ার বেগমকে (৬০) শ্বাসকষ্টের কারণে গত ২ ফেব্রুয়ারি রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করেন৷ ভর্তির ৫ দিন পরও চিকিৎসকেরা বলছিলেন না তার মায়ের কী হয়েছে৷ প্রতিদিন কিছু কিছু করে টেস্ট দেওয়া হয়, রিপোর্ট দেখার পরও চিকিৎসকরা কিছু বলেন না৷ ৭ ফেব্রুয়ারি সকালে চিকিৎসকরা রাউন্ডে আসলে রিপন তাদের কাছে জানতে চান তার মায়ের কী হয়েছে? তখন তাকে কিছু বলেননি চিকিৎসকরা৷ এ সময় তার মা চিকিৎসকদের কাছে তার অসুখের কথা জানতে চান৷ বরং তাদের প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে চিকিৎসকেরা নিজেদের মধ্যে পড়াশোনার বিষয়ে আলোচনা চালিয়ে যেতে থাকেন৷ এতে রিপন বিরক্ত হয়ে বারবার প্রশ্ন করতে থাকেন৷

'রুমের ছিটকানি বন্ধ করে পিটানো হয়েছে আমাকে'

সুমন পারভেজ রিপন ডয়চে ভেলেকে বলেন, "আমার প্রশ্নের কারণে তারা আমাকে অশিক্ষিত বলে ক্ষুব্ধ হয়ে চলে যান৷ তখন মায়ের শ্বাসকষ্ট হচ্ছিল৷ আমি মাকে নেবুলাইজার দেওয়ার উদ্যোগ নিই৷ এর মধ্যে একজন ইন্টার্ন চিকিৎসক এসে আমাকে বলেন, আপনি তো মায়ের কী হয়েছে জানতে চান? আমাদের রুমে আসেন৷ আমি রুমে ঢুকতেই দেখি ১৫-২০ জন অপেক্ষা করছে৷ এর মধ্যে একজন আনসারও আছে৷ একজন রুমের ছিটকানি বন্ধ করে দেয়৷ এরপর তারা আমাকে নির্দয়ভাবে পেটাতে থাকে৷ আধা ঘণ্টা ধরে তারা আমাকে পেটায়৷ এ সময় একজন আমাকে বলেন, বাইরে যদি এই ঘটনা বলি তাহলে তারা ইঞ্জেকশন দিয়ে আমার মাকে মেরে ফেলবে৷ বাইরে বের হয়ে যেন আমি সোজা হয়ে হাঁটি৷ পেটানোর এক পর্যায়ে আমি পকেট থেকে মোবাইল ফোন বের করে ভিডিও চালু করে দেই৷ প্রথম দুই মিনিট ভিডিও দেখা গেলেও পরে আর দেখা যায়নি কারণে মোবাইল তখন ভিডিও চালু করা অবস্থায় পকেটে মধ্যে রেখে দেই৷”

শুক্রবার বিকেলে ডয়চে ভেলের সঙ্গে আলাপকালে মি. রিপন বলেন, "আমি এখন একটা ফেসবুক পোস্ট লিখছি, কিছুক্ষণের মধ্যে পোস্ট করব৷ আমি বা আমার মায়ের মৃত্যুর জন্য ওই চিকিৎসকরা দায়ী থাকবেন৷ ওই ঘটনার পর আমার মাকে হাসপাতাল থেকে বাসায় এনে ফেলে রেখেছি৷ অথচ এখনও তার শ্বাসকষ্ট হচ্ছে৷ আমি নিজেও চিকিৎসা নিতে কয়েকটি হাসপাতালে গিয়েছিলাম৷ কেউ চিকিৎসা করাতে রাজি হয়নি৷ পরে মুখ লুকিয়ে বৃহস্পতিবার রাতে একটি হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলাম৷ পরে চলে এসেছি৷ প্রচণ্ড অসুস্থ বোধ করছি৷ হাসপাতালের পরিচালকের কাছে লিখিত অভিযোগ করেছি৷ এখনও কোন বিচার পাইনি৷”

রিপনের সেই ৭ মিনিট ১০ সেকেন্ডের ভিডিওটি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়েছে৷ ভিডিওটির প্রথম ২ মিনিট ১৫ সেকেন্ড দেখা গেলেও পরের অংশটুকু অন্ধকার৷ তবে মারধরের শব্দ, আকুতি, অশ্লীল কথাবার্তা এসব বোঝা যাচ্ছিল৷ রিপনকে বলতে শোনা যাচ্ছিল, "আর মাইরেন না ভাই৷ ম্যালা মাইর‌্যাছেন ভাই৷ আমাকে একটু পানি খেতে দেন৷ আমি মরে যাব৷ আমি ভুল করেছি৷ ক্ষমাই চাইছি৷ আর মাইরেন না৷ আমাকে মারার কথা আম্মাকে বইলেন না৷ আম্মা অসুস্থ হয়ে পড়বে৷” এ সময় চিকিৎসকদের একজনকে রিপনকে অশ্লীল ভাষায় গালাগাল করতে শোনা যায়৷ এক পর্যায়ে একজন চিকিৎসক বলেন, "বল মাফ চাইছস৷” তখন রিপন বলেন, "হ, মাফ চাইছি৷” এরপরও রিপনকে মারধরের শব্দ শোনা যায়৷ একজন তার মাথা ন্যাড়া করে দিতে চান৷ এ ছাড়া ‘চিকিৎসকদের মারতে চাওয়ায়' রিপনের হাত কেটে নিতে চান আরেকজন৷

এই ঘটনার বিষয়ে জানতে চাইলে হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এফ এম শামীম আহমেদ ডয়চে ভেলেকে বলেন, "এ বিষয়ে রিপন আমার কাছে অভিযোগ করেছে৷ আমি একটি বিভাগের সভাপতিকে প্রধান করে একটি কমিটি করেছি৷ রিপোর্ট পেলে সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে৷ তবে সঙ্গে সঙ্গে আমি ফরহাদ হাসান ও আলমগীর হোসেন নামে দুইজন ইন্টার্ন চিকিৎসককে সময়িক বরখাস্ত করেছি৷” 

'দুইজন ইন্টার্ন চিকিৎসককে সাময়িকভাবে বরখাস্ত করেছি'

চিকিৎসকরা কেন রোগীর স্বজনের গায়ে হাত তুলবে? জানতে চাইলে মি. আহমেদ বলেন, "এটা তো কোনোভাবেই কাম্য নয়৷ আসলে ১২শ' শয্যার হাসপাতালে রোগী থাকে সাড়ে ৩ হাজার৷ বর্হিবিভাগে প্রতিদিন ৬ হাজারের বেশি রোগী আসে৷ সবকিছু মিলিয়ে প্রতিদিন ৩০ হাজার মানুষকে আমাদের হ্যান্ডেল করতে হয়৷ এসব কারণে অনেক সময় ধৈর্যচ্যুতি ঘটতে পারে৷ তবে কারো গায়ে হাত দেওয়া কোনোভাবেই সমর্থনযোগ্য নয়৷”

অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে ফরহাদ হাসান ডয়চে ভেলেকে বলেন, "কেন এই পরিস্থিতির সৃষ্টি হল, সেটা তো আমরা বলতেই পারি৷ কিন্তু পরিচালক মহোদয় আমাদের কোন কথা বলতে নিষেধ করেছেন৷ যেহেতু তদন্ত চলছে, ফলে আমরা কিছু বলতে পারি না৷ তদন্ত অনুযায়ি যে ব্যবস্থা নেওয়া হবে, সেটা আমরা মেনে নেব৷”

গত ৫ বছরে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ইন্টার্ন চিকিৎসকদের অন্তত ১০ জন রোগীর স্বজন লাঞ্ছিত হয়েছেন৷ ২০২০ সালের সেপ্টেম্বরে একজন মুক্তিযোদ্ধার স্ত্রীর লাশ ওয়ার্ডে রেখে ওই মুক্তিযোদ্ধা ও তার ছেলেকে পিটিয়েছিলেন ইন্টার্ন চিকিৎসকেরা৷ জানতে চাইলে স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদের (স্বাচিপ) রাজশাহী জেলার সভাপতি ডা. চিন্ময় কান্তি দাস ডয়চে ভেলেকে বলেন, "একদিনে এই পরিস্থিতি তৈরি হয়নি৷ আমাদের সংকটের মূলে যেতে হবে৷ হাসপাতালে ঢুকলেই দেখবেন শত শত অ্যাম্বুলেন্স৷ দালালদের চক্করে সাধারণ মানুষের পক্ষে সেখানে কাজ করা কঠিন৷ আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর এসব ঘটনা দেখতে হবে৷ পাশাপাশি কোনো ঘটনা ঘটলে সেটার তদন্ত করে দোষীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে সেটা যেই হোক৷ আমরা চাই সুষ্ঠু একটা চিকিৎসার পরিবেশ যেন গড়ে ওঠে৷”

একই ধরনের ঘটনা বারবার?

গত ১৪ ডিসেম্বর দুপুরে বরিশাল শের ই বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মেডিসিন বিভাগে চিকিৎসাধীন গৌরনদীর রিজিয়া বেগম গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়ে৷ তখন ব্যক্তিগত কাজের অজুহাত দেখিয়ে চিকিৎসা দিতে অসম্মতি জানায় দায়িত্বরত চিকিৎসক৷ পরে বিনা চিকিৎসায় রোগীর মৃত্যু হলে রোগীর এক স্বজন চিকিৎসকের রুমে কথা বলতে যান৷ এসময় আনসার সদস্যদের সহযোগিতায় দায়িত্বরত চিকিৎসকরা তার উপর হামলা চালায়৷ এ সময় সেখানে উপস্থিত বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের শিক্ষার্থী তামিম ইকবাল রাজু ও তার বন্ধু মুজাহিদ প্রতিবাদ করেন৷ চিকিৎসকরা তাদেরও মারধর করে মোবাইল ছিনিয়ে নেয়৷

মৃত রোগীর স্বজন মো. নাসির বলেন, "আমার দাদী রিজিয়া বেগম অসুস্থ হয়ে পড়ে৷ দাদীকে একটু দেখার জন্য চিকিৎসককে বারবার অনুরোধ করি, কিন্তু তারা আসেনি৷ যার আধা ঘণ্টা পরে আমার দাদি মৃত্যুবরণ করেন৷ এরপর আমার চাচা ও আমি চিকিৎসকদের বলি, আপনারা কি মানুষ? আপনার মা বাবা অন্য কারও এমন হলে আপনি কী করতেন৷ এমন কথা বলায় তারা কয়েকজন মিলে আমাদের এলোপাথাড়ি কিল, ঘুসি মারতে শুরু করে৷ এমনকি আমার ব্যবহৃত মোবাইল ফোনটি ছিনিয়ে নিয়ে ভেঙে ফেলে৷ এমনকি আমার দাদীর মরদেহটিও আটকে রাখে৷”

চিকিৎসকদের এই ধরনের ব্যবহারের বিষয়ে জানতে চাইলে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমিরেটাস অধ্যাপক ডা. এ বি এম আব্দুল্লাহ ডয়চে ভেলেকে বলেন, "রোগীদের সঙ্গে চিকিৎসকদের এই ধরনের আচরণ কোনভাবেই কাম্য নয়৷ সবাইকে সহনশীল হতে হবে৷ আসলে আমাদের সমাজে এক ধরনের অস্থিরতা ছড়িয়ে পড়েছে৷ এর প্রভাবের বাইরে নন চিকিৎসকরা৷ চিকিৎসকদের বুঝতে হবে এটা মহান পেশা৷ অন্য পেশাগুলোর সঙ্গে মেলালে হবে৷ রাজনৈতিক কারণে কেউ ক্ষমতাবান হয়ে অন্য কারও সঙ্গে খারপ ব্যবহার করতে পারেন না৷”

বগুড়া শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজ (শজিমেক) হাসপাতালেও ২০১৯ সালে ইন্টার্ন চিকিৎসকদের মারধরে আহত হয়েছিলেন হৃদরোগী মাজেদা বেগম (৫০), তার ভাই ও তিন ছেলেমেয়ে৷ কার্ডিওলজি বিভাগ থেকে মাজেদা বেগমকে অবজারভেশন ওয়ার্ডে স্থানাস্থর নিয়ে বাকবিতণ্ডার জের ধরে মুক্তিযোদ্ধা পরিবারটির সঙ্গে এই অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটে৷ পরে রোগী ও তার লোকজনদের ছাড়পত্র দিয়ে হাসপাতাল থেকে বের করে দেয়া হয়েছে৷ ঢাকা মেডিকেলেও গত বছর একই ধরনের ঘটনা ঘটেছে৷ রোগীর স্বজনের সঙ্গে তর্কাতর্কির জেরে কর্মবিরতিতে যান ইন্টর্ন চিকিৎসকরা৷

জানতে চাইলে বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমএ) সভাপতি ডা. মোস্তাফা জালাল মহিউদ্দিন ডয়চে ভেলেকে বলেন, "এক চোখে দেখলে হবে না৷ চিকিৎসকরাও তো লাঞ্ছিত হচ্ছেন৷ এগুলোও দেখতে হবে৷ তবে আমি কারও পক্ষে সাফাই গাচ্ছি না৷ যে ঘটনায় যিনি অভিযুক্ত হবেন, তার বিরুদ্ধেই ব্যবস্থা নিতে হবে৷ আমরা খুব শিগগিরই মন্ত্রীর সঙ্গে এসব নিয়ে বসব৷ আশা করি সমাধানের একটা পথ বের হবে৷”