1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

লেখকের মুণ্ডচ্ছেদের হুমকি

শীর্ষ বন্দ্যোপাধ্যায় কলকাতা
৯ সেপ্টেম্বর ২০১৮

মহাকাব্যিক চরিত্র কৃষ্ণকে নিয়ে একটি লেখা লিখেছেন মহাভারত-গবেষক শামিম আহমেদ৷ তাতে কিছু তথ্য প্রমাদ থাকায় তাঁর শিরশ্ছেদের ফতোয়া দিয়েছে হিন্দুত্ববাদীরা৷

https://p.dw.com/p/34a6i
Indien Clothes of God Vrindavan Fabrik Stoff Stoffe Kleidung
ছবি: DW

মহাভারত বিশ্বের শ্রেষ্ঠ মহাকাব্যগুলির অন্যতম৷ তার কাহিনীবিন্যাস, তার চরিত্রচিত্রণ, ঘটনার পরতে পরতে মিশে থাকা রাজনীতি, সমাজনীতি এবং মনস্তত্ত্ব যুগ যুগ ধরে মানুষকে এগিয়ে গিয়ে ভাবতে প্রণোদিত করেছে৷ যে কারণে মহাভারতের বহু ভাষ্য তৈরি হয়েছে, বহু ব্যাখ্যা হয়েছে তার৷ এবং বিভিন্ন অঞ্চল, তার সমাজ, সংস্কৃতি, দর্শনের প্রেক্ষিতে এবং বিভিন্ন ভাষ্যকারের বয়ানে এক এক ধরনের নির্মাণ এবং বিনির্মাণ হয়েছে এই মহাকাব্যের৷ কাজেই কোন ভাষ্যটি প্রামাণ্য এবং সঠিক, এই তর্ক তোলাটাই বাতুলতা৷ বরং এই মুক্তচিন্তাকেই স্বীকৃতি দিতে হয় যে যুগান্ত বিস্তৃত এই মহাকাব্যের দর্শন এবং ব্যাখ্যা যিনি যেভাবে করেন, মহাভারত ঠিক তাই৷ নির্দিষ্ট কোনো সংজ্ঞায়, বর্ণনায় তাকে বাঁধার চেষ্টা করাটাই বরং ভুল৷

কিন্তু সেই ভুল ধারণা দিয়েই বিদ্ধ করার চেষ্টা হলো মহাভারত গবেষক শামিম আহমেদকে, যিনি সম্প্রতি পৌরাণিক চরিত্র কৃষ্ণকে নিয়ে একটি নিবন্ধের কারণে হিন্দুধর্মের অবমাননার দায়ে দোষী সাব্যস্ত হয়েছেন৷ শামিমের ওই লেখা কিছু তথ্যের প্রমাদের দায়ে দুষ্ট৷ তার মধ্যে একটি প্রমাদ অনবধানতাবশত বলে স্বীকার করে নিয়ে শামিম লিখিতভাবে দুঃখ প্রকাশও করেছেন৷ কিন্তু তার পরেও বিতর্ক থামছে না৷ কারণ, ওই ভাষ্যের ভিন্নতা, যা মহাভারতের পরিচিত, প্রচলিত ভাষ্যের সঙ্গে মিলছে না৷ অন্য পণ্ডিত, গবেষকরা নিজস্ব যুক্তি, তথ্য দিয়ে শামিমের বক্তব্যকে খণ্ডনের চেষ্টা করছেন, যে কোনো বৌদ্ধিক বিতর্কে যা সবসময়ই স্বাগত৷ কিন্তু বিষয়টা সেখানেই থেমে থাকছে না৷ হিন্দুত্ববাদী শিবির এটাকে পুরুষোত্তম কৃষ্ণের চরিত্রহননের উদ্দেশ্যমূলক চেষ্টা হিসেবে দেখছে এবং যেহেতু লেখকের নাম রামসেবক না হয়ে শামিম, তাঁর পদবি চতুর্বেদী না হয়ে আহমেদ, অসৎ উদ্দেশ্য প্রমাণের কাজটি সহজ হয়ে যাচ্ছে৷

শামিম আহমেদ

যথারীতি ফনা তুলেছে সেই পুরনো কুযুক্তি যে, হিন্দুদের উপাস্য কৃষ্ণকে নিয়ে কুকথা না বলে, শামিম তাঁর নিজের ধর্মের আরাধ্য চরিত্রদের নিয়ে কেন লিখছেন না!‌ এবং পেশায় দর্শনের অধ্যাপক, মহাভারত নিয়ে গবেষণায় পরিচিত নাম শামিম, যাঁর মহাভারতের একাধিক বিষয় নিয়ে প্রকাশিত বই আছে, তিনি যে হিন্দুধর্মকে খাটো করে দেখাতেই কৃষ্ণের বদনাম করেছেন, হিন্দুত্ববাদীরা সে ব্যাপারে নিশ্চিত৷ সেজন্য ক্ষমা চাওয়া থেকে শুরু করে ভবিষ্যতে কৃষ্ণ বা মহাভারত নিয়ে কিছু না লেখার প্রতিশ্রুতি, এমনকি ‘বিধর্মী' শামিমের শিরশ্ছেদের দাবি, সবই তুলছে হিন্দুত্ববাদীরা৷‘‌বৈদিক ধর্মীয় সংগঠন'‌ নামে একটি গোষ্ঠী ফেসবুকের মতো প্রকাশ্য সোশাল মিডিয়ায় শামিম আহমেদের শিরশ্ছেদ করার জিগির তুলেছে৷ এবং সাধারণের মধ্যে থেকে এমন জবাবদিহি তো চাওয়াই হচ্ছে যে একজন মুসলিম লেখক কেন কৃষ্ণের মতো একজন যুগাবতারের চরিত্র কলঙ্কিত করার অপচেষ্টা করছেন?‌

মানসিকভাবে আহত এবং আশঙ্কিত শামিম এ কারণে এমনও ভেবেছিলেন যে, সত্যিই ভবিষ্যতে এসব বিষয় নিয়ে আর তিনি লিখবেন না৷ এই অবাঞ্ছিত বিতর্কের পর শামিম ডয়চে ভেলের কাছেই প্রথম প্রতিক্রিয়া দিয়েছেন৷ তাঁর বক্তব্য, মহাভারতকে সাহিত্য হিসেবে দেখলেও, যেহেতু কৃষ্ণকে অনেকেই আরাধ্য হিসেবে দেখেন, তাঁর পূজা করেন, তাঁদের ভাবাবেগ যাতে আহত না হয়, সেটা তাঁকে দেখতেই হয়৷ কিন্তু তার পাশাপাশি মহাভারতের মূল বয়ানে কী লেখা আছে, সেটাও তো দেখতে হবে৷ কারণ, ওই উপাসকরা তো ব্যাসদেবের থেকে বড় নন৷ তিনি কীভাবে কৃষ্ণচরিত্র এঁকে গেছেন, সেটা পড়তে হবে এবং লিখতে হবে৷ হয় আক্ষরিকভাবে, যা লেখা আছে, তাই লিখতে হবে, অথবা নিজের মতো করে বুঝে লিখতে হবে৷

দেবতোষ দাশ

‘‌‘‌সবাই তো একরকম ভাবে বোঝে না৷ মহাভারতকে নানারকম ভাবে বোঝা যায়৷'‌'‌ ডয়চে ভেলেকে বলেছেন শামিম৷ জানাচ্ছেন, ‘‌‘‌এই দোটানাও কাজ করে যে, একদিকে তাঁর উপাসকদের আমি আঘাত করব না, আবার মূল ভাষ্যকেও অনুসরণ করব, একজন গবেষকের জায়গা থেকে কথাগুলো বলব৷ এই টানাপোড়েন সবসময়ই কাজ করে৷'‌'‌ আর সেই জায়গা থেকেই তাঁর উপলব্ধি, ‘‘সবসময় যদি মনে হয় একে আঘাত করব না, ওকে হতাশ করব না, সেই ভেবে যদি লিখতে হয়, তার থেকে না লেখাই ভালো৷''

তবে সমসাময়িক সাহিত্যিকরা কিন্তু কেউ চাইছেন না, হিন্দুত্ববাদীদের হুমকির মুখে থমকে যাক শামিমের কলম৷ বরং আরো বেশি করে লেখা উচিত৷ এটাও জানিয়ে দিতে যে হুমকিতে কেউ ভয় পায়নি৷ ডয়চে ভেলেকে বললেন সাহিত্যিক দেবতোষ দাশ৷ তাঁর সোজাসাপ্টা কথা, ‘‌‘‌আমি যদি সত্যি সত্যিই শিল্পী–সাহিত্যিক হয়ে থাকি, শিল্পী–সাহিত্যিক মানেই তো সে প্রচলিতের বিরুদ্ধে, তা হলে আমার কলম আমাকে দিয়ে লিখিয়ে নেবে, আবার তুলি আমাকে দিয়ে আঁকিয়ে নেবে৷ আমি যদি সিনেমা করি, আমার ক্যামেরা আমাকে দিয়ে ছবি তুলিয়ে নেবে৷ কিছুতেই ওটা আটকাতে পারব না৷ কাজেই এটা পরিষ্কার যে ভয় পাওয়ার কোনো জায়গাই নেই৷'‌'‌

একা দেবতোষ নন, এই মুহূর্তে তাঁর মতো আরও অনেকেই ভাবছেনযে, লেখক–শিল্পীর নিরাপত্তার দায়িত্ব প্রাথমিকভাবে সরকারের, আইনের৷ কিন্তু তা যদি না হয়, আইন বা প্রশাসন যদি সেই সুরক্ষা না দিতে পারে, তাহলে লেখকদের রাস্তায় নেমে নিজের অধিকার আদায় করে নিতে হবে৷ ভয় পেলে হবে না৷