1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান
রাজনীতিমিয়ানমার

সংকটের দ্রুত সমাধান নেই: মিয়ানমারে জাতিসংঘের সাবেক প্রধান

২৮ মার্চ ২০২৪

মিয়ানমারের গৃহযুদ্ধ নিরসনে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে চলিত প্রথার বাইরে গিয়ে ভাবতে হবে। জাতিসংঘের সাবেক সহকারী মহাসচিব এবং মিয়ানমার বিশেষজ্ঞ চার্লস পেট্রি এমনটাই মনে করেন বলে জানিয়েছেন ডয়চে ভেলেকে।

https://p.dw.com/p/4eEBZ
Myanmar, Namhsan | Weibliche Mitglieder der Mandalay People’s Defense Forces
ছবি: AFP

অভ্যুত্থানের মাধ্যমে গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত সরকারকে উৎখাত করার তিন বছর পর মিয়ানমারে গৃহযুদ্ধ শুরু হয়। কিন্তু এখন জান্তা সরকারের ক্ষমতা প্রতিরোধের মুখে সবচেয়ে বেশি নড়বড়ে মনে হচ্ছে।

একদিকে জান্তাবিরোধী পিপলস ডিফেন্স ফোর্সেস- পিডিএফ সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য দেশজুড়ে কয়েক হাজার তরুণ নিয়োগ করেছে। অন্যদিকে, নৃতাত্ত্বিক সংখ্যালঘু যোদ্ধাদের একটি জোট চীনের সীমান্তবর্তী উত্তর শান রাজ্যের অঞ্চল দখল করতে সক্ষম হয়েছে।

দক্ষিণ-পূর্বের কায়িন রাজ্য এবং পশ্চিমের চিন রাজ্যেও সাফল্য অর্জন করেছে মিলিশিয়ারা।

সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধরত নৃতাত্ত্বিক ও গণতান্ত্রিক শক্তিগুলো আগের চেয়ে অনেক বেশি ঐক্যবদ্ধ হওয়ায় সশস্ত্র প্রতিরোধকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে জান্তা সরকারকে বেশ বেগ পেতে হচ্ছে।

শক্তি প্রদর্শনের জন্য সামরিক বাহিনী বুধবার বার্ষিক সশস্ত্র বাহিনী দিবসের কুচকাওয়াজ করেছে। এই দিনে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জাপানি দখলদারিত্বের বিরুদ্ধে প্রতিরোধের সূচনাকে স্মরণ করে দেশটির সেনাবাহিনী।

জাতিসংঘের সাবেক সহকারী মহাসচিব চার্লস পেট্রি ১০ বছরেরও বেশি সময় ধরে মিয়ানমারে সরাসরি সম্পৃক্ত ছিলেন। তিনি সম্প্রতি যুদ্ধ-বিধ্বস্ত কারেনি রাজ্যে গিয়েছিলেন সেখানকার পরিস্থিতি এবং এর মানবিক প্রভাব মূল্যায়ন করতে।

ডিডাব্লিউকে দেয়া একটি সাক্ষাত্কারে, তিনি বলেছেন, "মিয়ানমারে পরিবর্তন ঘটেছে। সেনাবাহিনীকে নিয়ে ভয় এবং প্রতিরোধ থেকে সরে গিয়ে প্রশাসনের বিকল্প রূপ খুঁজে বের করার দিকে ঝুঁকছে মিয়ানমার।"

ডিডাব্লিউ: আপনার সাম্প্রতিক মিয়ানমার সফরের মূল কারণ কী ছিল?

চার্লস পেট্রি: আসলে, আমি সেখানে গিয়েছিলাম দুটো কারণে। প্রথমটি ছিল আন্তর্জাতিক মানবিক সহায়তা জনগণের কাছে পৌঁছাচ্ছে কিনা তা বোঝার জন্য। কিন্তু তারচেয়েও গুরুত্বপূর্ণ ছিল, আমি স্থানীয়ভাবে চালু হওয়া শাসন কাঠামোর ধারণা পেতে চেয়েছিলাম।

আমি স্থানীয় কাউন্সিলগুলোর উত্থানের কথা শুনেছিলাম, এই কাঠামোগুলো কেমন সে বিষয়ে আরও ভাল ধারণা পেতে চেয়েছিলাম। এবং আমি যা পেয়েছি তা আসলে আমার কল্পনার চেয়েও অনেক বেশি ইতিবাচক ছিল।

সেটা কিভাবে?

দেশের সেনাবাহিনীর নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে অভ্যুত্থানটি মূলত ব্যর্থ হওয়ার একটি কারণ হল জনগণের প্রতিরোধ, এবং আরও সুনির্দিষ্টভাবে বললে তরুণ প্রজন্মের প্রতিরোধ। এই তরুণরা নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ রক্ষা করে, সামাজিক মাধ্যমে দক্ষ, দেশের অভ্যন্তরে এবং বাইরের বিশ্বের সঙ্গেও অনেক বেশি সংযুক্ত।

এই নতুন প্রজন্ম বর্তমান প্রতিরোধের মেরুদণ্ড। কারণ তাদের বাবা-মায়ের মতো তারা সেনাবাহিনীকে এতটা ভয় করে না। এর আগে মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী কিভাবে দেশ নিয়ন্ত্রণ করছে, তা নির্ভর করতো জনগণের সেল্ফ-সেন্সরশিপের ওপর।

এই তরুণ অ্যাক্টিভিস্টরা আমাকে বলেছে: 'এটি কেবল একটি গৃহযুদ্ধ নয়; এটি একটি বিপ্লব।' এবং আমি সত্যিই তাতমাদো এর [মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর] বিরুদ্ধে এই জনপ্রিয় প্রতিরোধে নতুন কিছু খুঁজে পেয়েছি।

আমি মনে করি মিয়ানমারে অবশ্যই একটি সুস্পষ্ট পরিবর্তন ঘটেছে। দেশটিতে সেনাবাহিনীর প্রতি ভয় এবং প্রতিরোধ এখন প্রশাসনের বিকল্প রূপ প্রদানের দিকে মোড় নিচ্ছে৷ আমি মনে করি, দেশের ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তার ক্ষেত্রে ২০২১ সাল মিয়ানমারে একটি পরিবর্তনের সূচনা করেছে৷

চার্লস পেট্রি
চার্লস পেট্রি বলেছেন, ‘আমি মনে করি মিয়ানমারে অবশ্যই একটি সুস্পষ্ট পরিবর্তন ঘটেছে।’ছবি: Privat

আরেকটি বিষয় হচ্ছে, দ্রুত সমাধানের জন্য কোনও উপায় নেই। দুর্ভাগ্যবশত আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের মধ্যে অনেকেই এমন উপায় খুঁজছেন। তারা যুক্তি দিচ্ছেন, 'আসুন দুর্ভোগ কমানোর জন্য লড়াই থামানোর চেষ্টা করি'। কিন্তু প্রতিরোধের আন্দোলনকারীরা দ্রুত সমাধান চায় না। তারা একটি বহু পুরনো ঐতিহাসিক সমস্যার সমাধান চায় যা দেশকে জর্জরিত করছে।

কিছু আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষক উদ্বিগ্ন যে সংগ্রামের কারণে দেশটি ভেঙে পড়তে পারে। আপনার দৃষ্টিতে মিয়ানমারের ইউনিয়ন ভেঙে যাওয়া কি হুমকি নাকি সুযোগ?

দেশটি টুকরো টুকরো হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু এর কারণ হচ্ছে দেশটির অনেক অংশে মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর নিয়ন্ত্রণ হারানো। আমরা এখন যা দেখছি তা হল নতুন এক ধরনের শাসনব্যবস্থার আবির্ভাব। কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হচ্ছে, নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠীগুলোর কেউই স্বাধীনতা চাইছে না।

আমরা যা দেখছি তা হল এক ধরনের ফেডারেলিজমের আকাঙ্ক্ষা যা বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর অধিকার এবং তাদের একসঙ্গে কাজ করার ক্ষমতা নিশ্চিত করবে।

আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় বলছে যে তারা দেশটির বিভক্তির জন্য দায়ী হতে চায় না। আমি বলছি এটি কোনো সমস্যা নয়, অন্তত এখনই নয়।

এর পরিবর্তে এই মুহূর্তে সমস্যাটি হল: আপনি কীভাবে একটি শক্তিশালী কেন্দ্র ছাড়া মিয়ানমারের মতো একটি রাষ্ট্রকে কল্পনা করবেন। বিচ্ছিন্নভাবে শাসিত নানা এলাকার এই বাস্তবতাকে স্বীকার করে একটি ফেডারেলিজমের রূপ কল্পনা করতে হবে, যা সবকিছুকে একসঙ্গে ধরে রাখবে।

এই নতুন রাষ্ট্রব্যবস্থার উত্থানের কারণেই কি মিয়ানমারে জাতিসংঘ কঠিন সময় পার করছে?

প্রথাগত নয়, এমন কিছু পশ্চিমা সরকার এবং জাতিসংঘ গ্রহণ করতে পারছে না। আমি মনে করি এই মুহূর্তে মৌলিক সমস্যা হচ্ছে পরিস্থিতি বুঝতে পারার অক্ষমতা এবং বর্তমান পরিস্থিতিতে তৈরি হওয়া সুযোগগুলোকে কাজে লাগিয়ে দেশটির ভবিষ্যত গড়ে তোলার ব্যাপারে অনাগ্রহ।

পশ্চিমা প্রতিষ্ঠান, জাতিসংঘ খুব ধীরগতিতে চিন্তা করে এবং প্রথার বাইরে চিন্তা করতে প্রায় অক্ষম। তবে মিয়ানমারে এটিই প্রয়োজন।

আপনি কি আমাদের আরও সুনির্দিষ্টভাবে বলতে পারবেন, কিভাবে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় এবং জাতিসংঘের এই পরিস্থিতি মোকাবিলা করা উচিত?

প্রথম যে জিনিসটি আমি বলবো তা হল নম্রতা। বিনয়ী হোন এবং উপলব্ধি করুন যে আপনি অন্য কারো যুদ্ধ নিয়ে কথা বলছেন। এটা করতে পারলে আপনার নিজের দৃষ্টিভঙ্গি তাদের ওপর চাপিয়ে দেবেন না।

আমি যখন সেখানকার মানুষ এবং তাদের নেতাদের সঙ্গে কথা বলি তখন আমার খুব ভালো লাগে যে তারা আন্তর্জাতিক সমর্থনের ওপর নির্ভর করছে না। জাতিসংঘের প্রতি তাদের ব্যাপক হতাশা রয়েছে। নিজেদের ব্যবস্থা তাদের নিজেদেরই করতে হয়েছে এবং তারা তা করে দেখিয়েছে। অতএব, বিনয়ী হতে হবে।

দ্বিতীয়ত, এটা উপলব্ধি করতে হবে, অভ্যুত্থানের আগে যে বিশ্লেষণ এবং পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়েছিল তা এখন আর কার্যকর নয়। নেপিদো-এর সঙ্গে আলোচনার সুযোগ নিশ্চিত করলেই আপনি আর দেশের অনেক দুর্বল জনগোষ্ঠীর সঙ্গে যোগাযোগের সুযোগ পাচ্ছেন না। কারণ সামরিক বাহিনী এখন এই অঞ্চলগুলো আর নিয়ন্ত্রণ করে না।

এর মানে হলো, আপনাকে দেশের অন্যান্য অংশে প্রশাসন ও শাসন কাঠামোর সঙ্গে সম্পৃক্ত হওয়া শুরু করতে হবে৷ কিন্তু এর মানে কেবল মাঝেমধ্যে তাদের দেখতে সেখানে যাওয়া নয়। পরিস্থিতি এখন একটি টেকসই যোগাযোগব্যবস্থা গঠনের দাবি রাখে৷ মূলত, স্থানীয় ব্যবস্থাকে পরবর্তী স্তরে নিয়ে যেতে হবে। তাদের জিজ্ঞাসা করুন কিভাবে সাহায্য পৌঁছাতে হবে। রাষ্ট্র ছাড়াও এই লড়াইয়ে অন্য যারা সম্পৃক্ত তাদের সঙ্গে সারগর্ভ আলোচনা করার সাহস রাখুন। মূল বিষয়টি হচ্ছে একটু ভিন্নভাবে পরিচালিত হওয়ার ইচ্ছাটা থাকতে হবে।

এই নতুন পদ্ধতি বিষয়ে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতিক্রিয়া কী?

আমি মনে করি মিয়ানমারে জাতিসংঘের প্রতিনিধি দলের সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো, এর নেতৃত্ব নেই। দলটি মূলত এতিম। অভ্যুত্থানের পর থেকে দেশটিতে জাতিসংঘের কোনো আবাসিক সমন্বয়কারী নেই। এর অর্থ হলো জাতিসংঘের সব সংস্থার প্রধানরা সার্বিক উন্নতির চেয়ে নিজস্ব দায়িত্ব এবং আদেশ পালন নিয়ে বেশি ব্যস্ত।

দেশটিতে কোনো নেতৃত্ব নেই এবং তারাও নিউইয়র্ক থেকে রোনো রাজনৈতিক নির্দেশনা ও নেতৃত্ব পাচ্ছেন না।

জাতিসংঘকে জরুরি ভিত্তিতে এই নেতৃত্বের সমস্যা মোকাবিলা করতে হবে। এরপর যুদ্ধে সম্পৃক্ত সকল পক্ষের সঙ্গে জড়িত হতে হবে। প্রাসঙ্গিকতা পুনঃপ্রতিষ্ঠা করার এই সুযোগটি জাতিসংঘ এড়িয়ে যেতে পারে না।

(চার্লস পেট্রি জাতিসংঘের সাবেক সহকারী মহাসচিব। দীর্ঘ কূটনৈতিক কর্মজীবনে তিনি মিয়ানমারে জাতিসংঘের আবাসিক সমন্বয়কারী হিসেবে প্রায় পাঁচ বছর কাজ করেছেন। আরও চার বছর (২০১২-১৫) মিয়ানমারের ঐতিহাসিক অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বের অবসান ঘটাতে নরওয়ের নেতৃত্বাধীন প্রচেষ্টার সমন্বয়কারী হিসাবেও দায়িত্ব পালন করেন।)

সাক্ষাৎকার নিয়েছেন ডিডাব্লিউ এর রোডিওন এবিগহাউজেন।

এডিকে/কেএম