1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

হলফনামার দরকার কী?

সমীর কুমার দে ঢাকা
১৫ ডিসেম্বর ২০২৩

নির্বাচন এলেই প্রার্থীরা হলফনামা জমা দেন৷ কয়েকদিন সংবাদপত্রে এই হলফনামা ফলাও করে ছাপা হয়৷ এই পর্যন্তই৷ এরপর হলফনামা ধরে কোন তদন্ত হয় না৷

https://p.dw.com/p/4aCNs
নির্বাচন ভবনের ছবি
বাংলাদেশে নির্বাচনে যারা প্রার্থী হতে চান, তাদের আয়-ব্যয় ও সম্পদের তথ্য হলফনামায় উল্লেখ করে নির্বাচন কমিশনে জমা দিতে হয়ছবি: bdnews24.com

কেউ ঠিক তথ্য দিলেন, না ভুল তথ্য দিলেন, কেউ সেটা যাচাই করে না৷ অথবা পাঁচ বছরের ব্যবধানে একজন মন্ত্রী বা এমপি কীভাবে আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ হলেন সে তথ্য কেউ খুঁজে বের করেন না৷ ফলে প্রশ্ন উঠেছে আদৌ কি হলফনামার কোন প্রয়োজনীয়তা আছে?

বাংলাদেশে নির্বাচনে যারা প্রার্থী হতে চান, তাদের আয়-ব্যয় ও সম্পদের তথ্য হলফনামায় উল্লেখ করে নির্বাচন কমিশনে জমা দিতে হয়৷ আগামী ৭ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত হতে যাওয়া দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অনেক প্রার্থীর সম্পদের পরিমাণ গত পাঁচ বছরে কয়েকশ গুণ পর্যন্ত বেড়েছে৷ অনেক প্রার্থীর নিজের নামে সম্পদ তুলনামূলক কম বাড়লেও তাদের স্ত্রীর নামে সম্পদের পরিমাণ শত গুণ পর্যন্ত বেড়েছে৷

সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী মনজিল মোরশেদ ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘দেশে এখন যে সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলো রয়েছে সেগুলোর গ্রহণযোগ্যতা আগেই হারিয়ে গেছে৷ এখন শুধুমাত্র প্রধানমন্ত্রী যদি মনে করেন, এসব দুর্নীতিবাজ লোকজনকে আওয়ামী লীগ থেকে বের করে দেবেন তাহলে পারেন৷ প্রধানমন্ত্রী চাইলে তাদের মনোনয়ন দেওয়া থেকে বিরত থাকতে পারেন৷ দুর্নীতির মামলায় বিরোধীদের যে বিচার হচ্ছে হোক, তাতে আমার কোন আপত্তি নেই৷ কিন্তু সরকারের মন্ত্রী এমপিদের হলফনামা ধরে যদি তদন্ত হয় তাহলে দুর্নীতির মামলায় অনেকেই জেলে যাবেন৷''

হলফনামা ধরে যদি তদন্ত হয় তাহলে অনেকেই জেলে যাবেন: মনজিল

২০১৩ সালের ২৫ ডিসেম্বর হলফনামা নিয়ে দৈনিক প্রথম আলোতে একটা কলাম লিখেছিলেন অ্যাডভোকেট শাহদীন মালিক৷ সেখানে তিনি বলেছেন, ‘‘মন্ত্রী-সাংসদেরা কি ধনী হতে পারেন না? যদি বৈধভাবে ব্যবসা-বাণিজ্য করে সম্পদ বাড়ান? আইন বলে, মন্ত্রীরা তাদের বেতন-ভাতাদি ছাড়া আর কোনো উপায়-অর্জন করতে পারবেন না৷ কোনো বৈধ ব্যবসাও করতে পারবেন না৷ এটা সংবিধান নিষেধ করে দিয়েছে৷ আট ধরনের সাংবিধানিক পদের বেতন-ভাতাসংক্রান্ত বড় একটা অনুচ্ছেদ আছে সংবিধানে৷ ১৪৭ অনুচ্ছেদে রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী-মন্ত্রী, বিচারপতি, নির্বাচন কমিশন ইত্যাদি আট ধরনের পদ ১৪৭ অনুচ্ছেদের আওতায় পড়ে৷ পাঠক যদি শপথ নিয়ে মন্ত্রী বনে যান, তাহলে ১৪৭ অনুচ্ছেদটি আপনাকে জানতে হবে৷ মন্ত্রী ‘...কোন লাভজনক পদ কিংবা বেতন-ভাতাদিযুক্ত পদ বা মর্যাদায় বহাল হইবেন না কিংবা মুনাফা লাভের উদ্দেশ্যযুক্ত কোন কোম্পানি, সমিতি বা প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা বা পরিচালনায় কোনরূপ অংশগ্রহণ করিবেন না৷''

ফলে একজন মন্ত্রী সরকারি সুবিধার বাইরে কোন আয় করতে পারবেন না৷ পারিবারিক সম্পত্তি থেকে যদি কোন আয় আসে সেটাও পরিবারের লোকজন পাবেন৷ তাহলে প্রশ্ন হল, মন্ত্রীদের আয় কীভাবে শতগুণ বাড়ছে? কয়েকদিন ধরে বাংলাদেশের সবগুলো সংবাদপত্রে যেটা শিরোনাম হচ্ছে, তার মধ্যে আছে হলফনামার তথ্য৷

হলফনামার প্রয়োজন হল কেন? এটা দেখার দায়িত্ব কার? জানতে চাইলে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘হলফনামায় প্রার্থীর আয়-ব্যয় সংক্রান্ত সবকিছু খতিয়ে দেখার সুযোগ আছে বিধায়ই এই প্রভিশনটা দেওয়া হয়েছে৷ কিন্তু সেটা যথাযথভাবে পালন করা হয় না৷ এটা দেখার দায়িত্ব মূলত তিনটি প্রতিষ্ঠানের৷ প্রথমত নির্বাচন কমিশনের৷ দ্বিতীয়ত দুর্নীতি দমন কমিশনের এবং তৃতীয়ত জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের৷ প্রত্যেক প্রার্থীই আয়কর রিটার্ন জমা দেন৷ সেটার সঙ্গে হলফনামার মিল আছে কিনা সেটা রাজস্ব বোর্ড দেখবে৷ কেউ দুর্নীতি করে টাকা উপার্জন করেছেন কিনা সেটা দেখবে দুর্নীতি দমন কমিশন৷ কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হল কেউ সেটা দেখেন না৷ নির্বাচন কমিশন তো নির্বাচনের পরও হলফনামায় মিথ্যা তথ্য দেওয়ার অভিযোগে কোন প্রার্থীর প্রার্থিতা বাতিল করতে পারেন৷ কিন্তু বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত একজনের ক্ষেত্রেও এমনকি ঘটেনি৷''

মনোনয়নপত্রের সাথে প্রার্থীর হলফনামা জমা দেয়ার নিয়ম কার্যকর হয় ২০০৮ সাল থেকে৷ যার মধ্যে প্রার্থীর আয়-ব্যয়, সম্পদের হিসাব, তার উপর নির্ভরশীলদের আয়-ব্যয়, সম্পদের হিসাব সম্পর্কিত যাবতীয় তথ্য অন্তর্ভুক্ত থাকে৷ হলফনামায় দেওয়া সম্পদের তথ্য অনুযায়ী, আয় ও সম্পদ বাড়ার পর তা নিয়ে সমালোচনা অবশ্য এবারই প্রথম নয়৷ বরং এর আগের নির্বাচনগুলোতেও অনেক প্রার্থীর বিরুদ্ধে একই ধরনের সমালোচনা সামনে এসেছে৷

সাবেক নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) ড. সাখাওয়াত হোসেন ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘আমরা এটা শুধু আইনের মধ্যেই এনেছি, এমনটি নয়৷ আমরা পুরো তালিকা জাতীয় রাজস্ব বোর্ডে পাঠিয়েছিলাম৷ পাশাপাশি হলফনামাগুলো দেখার জন্য নির্বাচন কমিশনে আলাদা জনবলের ব্যবস্থা করেছিলাম৷ কিন্তু তখন রাজস্ব বোর্ড থেকে কোন উত্তর পাইনি৷ পাশাপাশি সেই অতিরিক্ত জনবল এখনও আছে কিনা আমি জানি না৷ তবে হলফনামায় কেউ ভুল তথ্য দিলে সেটা দেখা নির্বাচন কমিশনের দায়িত্বের মধ্যে পড়ে৷ আবার কেউ দুর্নীতি করে অর্থ উপার্জন করলে সেটা দেখবে দুর্নীতি দমন কমিশন৷''

বেসরকারি প্রতিষ্ঠান সুশাসনের জন্য নাগরিক-সুজন ২০১৪ সালের নির্বাচন অংশ নেওয়া গুরুত্বপূর্ণ ৪৮ জন প্রার্থীর ২০০৮ সালের হলফনামা ও ২০১৪ সালের হলফনামা পর্যালোচনা করেছিল৷ তখন প্রতিষ্ঠানটি জানিয়েছিল যে, বেশ কয়েক জন প্রার্থীর আয় ২০০৮ সালের তুলনায় ২০১৪ সালে সর্বোচ্চ ৮ হাজার গুণ পর্যন্ত বেড়েছে৷ সবশেষ ২০১৮ সালে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর এতে অংশ নেওয়া গুরুত্বপূর্ণ ৫৩ জন প্রার্থী যারা দশম ও একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নিয়েছিলেন, তাদের হলফনামার আয়ের তথ্য বিশ্লেষণ করেছে সুজন৷ সেখানে বলা হয়, সর্বমোট ৫৩ জন প্রার্থীর আয় গড়ে ১০৬ দশমিক ৭৩ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে৷ আয় বৃদ্ধির এই হার ১০ দশমিক ৯১ শতাংশ থেকে শুরু করে সর্বোচ্চ ১ হাজার ১৫২ দশমিক ৭ শতাংশ পর্যন্ত বেড়েছে৷

সবকিছুই কেন্দ্র থেকে নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে: সুলতানা কামাল

হলফনামার সঙ্গে আয়কর বিবরণী জমা দেওয়ার বিধান বর্তমান কমিশন কার স্বার্থে বাতিল করেছে? এমন প্রশ্ন তুলে সুজন সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার বলেন, ‘‘হলফনামার বর্তমান আট দফার ছকে পরিবর্তন আনা দরকার৷ শুধু অংশগ্রহণমূলক নয়, নির্বাচন হতে হবে প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক৷ নির্বাচনে প্রার্থী বেছে নেওয়ার বিশ্বাসযোগ্য বিকল্প থাকতে হবে৷ প্রার্থীরা অনেক ক্ষেত্রে মনগড়া তথ্য দেন৷ কারণ তারা জানেন, এসব যাচাই-বাছাই হবে না৷ অথচ মিথ্যা তথ্য দিলে প্রার্থিতা বাতিল, এমনকি নির্বাচিত হয়ে গেলেও ফল বাতিল করতে পারে নির্বাচন কমিশন৷''

সুজন আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে নির্বাচন বিশ্লেষক ড. আব্দুল আলীম বলেন, ‘‘প্রার্থীর হলফনামা কোনোভাবেই যাচাই করা যাচ্ছে না৷ দুর্ভাগ্যবশত কোনো নির্বাচন কমিশনই এটি করেনি৷ দায়িত্ব এড়িয়ে চলছে৷ অথচ এই হলফনামা যাচাই করার কমিশনের অন্যতম দায়িত্ব৷''

হলফনামা বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, অনেক মন্ত্রী কৃষি থেকে আয় করেছেন বা মৎস্য চাষ থেকে লাখ লাখ টাকা আয় করেছেন৷ অ্যাডভোকেট শাহদীন মালিক বলেন, ‘‘কৃষি বা মৎস্য থেকে মুনাফা অর্জনে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রীর নিশ্চয় কোনো না কোনো ভূমিকা ছিল, সংবিধানের ভাষায়, পরিচালনা বা ব্যবস্থাপনায় নিঃসন্দেহে ভূমিকা ছিল৷ অর্থাৎ কোনো দুই নম্বরি হয়নি, সেটা ধরে নিলেও মন্ত্রীদের ব্যবসা করাটাই ছিল সংবিধানের পরিপন্থী৷ বেতন-ভাতার বাইরে উপরি আয় করে মন্ত্রীরা স্পষ্টতই সংবিধান লঙ্ঘন করেছেন৷ সংবিধান লঙ্ঘনের সাজা মন্ত্রী-সাংসদেরাই নির্ধারণ করে দিয়েছেন পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে৷ সংবিধানের ৭ক(৩) অনুচ্ছেদে সাজার বিধানটা বলা আছে৷''

সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা সুলতানা কামাল ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘আমাদের সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলো একেবারেই অকার্যকর হয়ে গেছে৷ এগুলো সেভাবে গড়ে তোলা হয়নি বা গড়ে উঠার সুযোগ দেওয়া হয়নি৷ তাদের কাজ করতেও দেওয়া হয়নি৷ সবকিছুই কেন্দ্র থেকে নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে৷ ফলে এসব প্রতিষ্ঠানের যে ক্ষমতা সেটা তাদের প্রয়োগ করতে দেওয়া হয় না৷ আমাদের নৈতিক স্খলন এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, যারা সংবিধান রক্ষার জন্য শপথ নেন তারাই নিজেদের স্বার্থে যা ইচ্ছে তাই করেন৷ এরজন্য তাদের কোন জবাবদিহিও করতে হয় না৷ যারা এই জবাবদিহি নিশ্চিত করবে সেই প্রতিষ্ঠানগুলোকে তারাই দুর্বল করে রেখেছেন৷ ফলে প্রতিবাদ করার ক্ষমতাও তারা হারিয়ে ফেলেছেন৷''

স্কিপ নেক্সট সেকশন এই বিষয়ে আরো তথ্য

এই বিষয়ে আরো তথ্য